citycellফড়িং মিডিয়া – ন্যাশনাল ডেস্ক: বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল অপারেটর প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিটিসেলকে ঋণ দিয়ে বিপাকে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তবে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে সিটিসেলকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্যারান্টিদাতা ব্যাংকগুলো। জানা গেছে, আর্থিক সংকটে পরে সিটিসেল ঋণ শোধ করতে না পারায় এখন এর দায় এসে পড়েছে গ্যারান্টিদাতা ব্যাংকের ওপর। ফলে ব্যাংকগুলো এখন সিটিসেলের নামে ফোর্সলোন (কোম্পানি না চাইলেও বাধ্যতামূলক ঋণ) সৃষ্টি করে অন্য ব্যাংকের দেনা শোধ করছে।

কিন্তু এই ফোর্সলোনের অর্থ কীভাবে ব্যাংকগুলো সিটিসেলের কাছ থেকে আদায় করবে সে বিষয়ে এখনই উদ্বিগ্ন। কেননা সরকার ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটিসেল বন্ধ করে দেওয়ার। যদিও গত সোমবার আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে দুই কিস্তিতে সরকারের পাওনা ৪৭৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা পরিশোধ করলে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করা যাবে না। ওই সময়ের মধ্যে সরকারের বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হলে সরকার সিটিসেলের ব্যাপারে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

সূত্র জানায়, সিটিসেল আগে থেকেই তাদের বিভিন্ন শেয়ার বিদেশি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরের সিংটেল ও রাশিয়ার মাল্টিনেটের সঙ্গে আলোচনা আগেই ব্যর্থ হয়ে গেছে। এখন তারা নতুন করে মেক্সিকান কোম্পানি টেলমেক্স ও চিনের একটি কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করছে। এ বিষয়ে সিটিসেল থেকে দাবি করা হয়েছে, বিদেশি একটি কোম্পানির সঙ্গে সিটিসেলের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।

তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। এ প্রসঙ্গে সিটিসেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহবুব চৌধুরী বলেন, নতুন বিনিয়োগকারীর সন্ধানে তারা কাজ করছেন। ইতোমধ্যে একজন বিনিয়োগকারী পাওয়া গেছে। এটি চূড়ান্ত হলে নতুন আঙ্গিকে আবার ফিরে আসবে সিটিসেল। তখন বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণের টাকাও পরিশোধ করে দেবে সিটিসেল।

সূত্র জানায়, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সিটিসেল এ পর্যন্ত দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক গ্যারান্টি রয়েছে ১২০০ কোটি টাকা। এই গ্যারান্টির বিপরীতেও তারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। আর্থিক সংকটে পড়ে গত প্রায় এক বছর ধরে সিটিসেল কোনো ঋণই পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে প্রতিষ্ঠানটি ঋণখেলাপি হয়ে যাচ্ছিল।

এ বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করে ঋণের মেয়াদ বাড়িয়েছে সিটিসেল। এর পরও ঋণের টাকা শোধ করতে পারছে না। এদিকে আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে সিটিসেলের ঋণগুলো ব্যাংক হিসাবেও দেখাতে পারছে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সিটিসেলকে ঋণদাতা ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, আগের ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করা পর্যন্ত সিটিসেলকে নতুন কোনো ঋণ না দিতে। ফলে সিটিসেল থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে নতুন ঋণ চাইলেও পাচ্ছে না।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ঋণের গ্যারান্টি দিলে ওই ঋণসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পরিশোধে ব্যর্থ হলে গ্যারান্টিদাতা ব্যাংকঋণ পরিশোধে বাধ্য। এটি ব্যাংকিং বিশ্বাসেরও আওতায় পড়ে। এ কারণে গ্যারান্টিদাতা ব্যাংকগুলো এখন সিটিসেলের নামে ফোর্সলোন সৃষ্টি করে অন্য ব্যাংক থেকে সিটিসেলের নেওয়া ঋণ শোধ করছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ব্যাংক বা লিজিং কোম্পানিগুলোর দেনা-পাওনার বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই, করারও নেই। কমিশন শুধু টেলিকম কোম্পানিটির লাইসেন্স প্রদান, শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার হস্তান্তর ও গ্রাহকদের বিষয়টি দেখভাল করতে পারে। এর বাইরে ঋণ নেওয়া বা দেওয়ার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এসব ক্ষেত্রে আমাদের কোনো অনুমোদনও নিতে হয় না। এটি একান্তই ব্যাংক বা লিজিং কোম্পানির বিষয়।

সূত্র জানায়, সিটিসেলের নামে সবচেয়ে বেশি ব্যাংক গ্যারান্টি রয়েছে এবি ব্যাংকের। এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমানে মালিকপক্ষের অন্যতম একজন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান। তিনি সিটিসেলেরও মালিকপক্ষের অন্যতম একজন। যে কারণে প্রভাব খাটিয়ে এবি ব্যাংক থেকে সিটিসেলের নামে ব্যাংক গ্যারান্টি নেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত এবি ব্যাংক থেকেই সবচেয়ে বেশি গ্যারান্টি নেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে এবি ব্যাংক সিটিসেলের নামে ফোর্সলোন সৃষ্টি করে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।

এসব বিষয়ে এবি ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রাইম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, এক ব্যাংকের গ্যারান্টিতে সিটিসেলকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। ওই ব্যাংক থেকে ২৫ কোটি টাকা তারা আদায় করেছে। তবে সুদ বাবদ এখনো কোটি টাকার মতো পাওনা রয়েছে। এনসিসি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, অন্য ব্যাংকের গ্যারান্টিতে দেওয়া সিটিসেলের ঋণ ইতোমধ্যে সমন্বয় করা হয়েছে।

সিটি ব্যাংকের ব্যাংক গ্যারান্টিতে ব্র্যাক ব্যাংক সিটিসেলকে ১৪৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। শর্ত অনুযায়ী সিটিসেল ওই ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হলে তারা সিটি ব্যাংকের কাছে ঋণ শোধের দাবি করে। এতে সিটি ব্যাংক গড়িমসি করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নালিশ করে ব্র্যাক ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঘটনার তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হলে সিটি ব্যাংককে ঋণ শোধের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সিটিসেলের নামে ফোর্সলোন সৃষ্টি করে সিটি ব্যাংক থেকে ব্র্যাক ব্যাংকের ঋণ শোধ করে দেওয়া হয়। সূত্র জানায়, সিটিসেলের কাছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) মূল ঋণের পরিমাণ ৪০ কোটি টাকা। সুদসহ পাওনা আরও বেড়েছে। এখন তা আদায়ের চেষ্টা চলছে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান এ বিষয়ে বলেন, দেনা শোধ না করায় সিটিসেল এখন সরকার ও ব্যাংকগুলোর জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঋণ দিয়ে অনেক ব্যাংক বিপদে পড়েছে। বন্ধ হওয়ার উপক্রম হওয়ায় সব পক্ষই সমস্যায় পড়েছে। এখন ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা নিজেরাও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করছি।

এ ছাড়া সিটিসেলের কাছে ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৬০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এএসএম বুলবুল বলেন, সিটিসেলের কাছে পাওনা আদায়ে তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। তাদের চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তবে আদালতের একটি স্থগিত আদেশ রয়েছে। ডিসেম্বর ওই স্থগিত আদেশের মেয়াদ শেষ হবে। আদালতের বিষয়টি নিষ্পত্তি করে আমরা সিটিসেলের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে জোর তৎপরতা চালাব। এ ছাড়া আরও কয়েকটি ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির কাছে সিটিসেলের ঋণ রয়েছে।

সূত্র: আমাদের সময়