ফড়িং মিডিয়া – অনলাইন ডেস্ক: টাঙ্গাইল সদর থেকে গড়পড়তা প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম দক্ষিণ পাথালিয়া। জেলা শহরের নতুন বাস টার্মিনাল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ৪৬ কিলোমিটার গেলে গোপালপুর বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত এই জনপদ অনেকটা হঠাৎ করেই ব্যাপক আলোচনায়।

কারণ এই গ্রামেই নির্মিত হচ্ছে ২০১টি গম্বুজ ও ৪৫১ ফুট উচ্চতার মিনারবিশিষ্ট আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর নান্দনিক এক মসজিদ। বলা হচ্ছে, এটি হতে যাচ্ছে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। নির্মাণ পর্যায়েই এটি সাধারণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। স্থাপনাটি দেখতে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিড় জমে থাকছে উত্সুক দর্শনার্থীর।

মসজিদটি নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। উদ্যোক্তা মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম কল্যাণ ট্রাস্ট। বিশ্ব মসজিদের ইতিহাসে জায়গা করে নিতে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে মসজিদটির নাম লেখা হবে বলে আশা করছেন ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম। তাঁর বিশ্বাস, নিপুণ কারুকাজ করা বৃহৎ স্থাপনাটি বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে নতুন করে পরিচিত করবে। আগমন ঘটবে দেশি-বিদেশি পর্যটক ও ওলি-আউলিয়ার।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মসজিদ কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ চলছে বেশ দ্রুততার সঙ্গেই। উদ্যোক্তা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের শেষের দিকে নির্মাণকাজ শেষ হবে এবং আগামী বছরের প্রথম দিকে পবিত্র কাবা শরিফের ইমামের ইমামতির মাধ্যমে মসজিদের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। আমন্ত্রণ জানানো হবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের বিশিষ্টজনদের।

উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলাম জানান, আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর নান্দনিক এমন মসজিদ নির্মাণে তিনি ২০১২ সালের প্রথম দিকে পরিকল্পনা করেন। ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি শুরু হয় এটির নির্মাণকাজ। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তাঁর মা রিজিয়া খাতুন। ব্যয়বহুল এই নির্মাণকাজ তিনি শুরু করেছিলেন ১৫ লাখ টাকা হাতে নিয়ে। পরে এর পরিকল্পনা দেখে বন্ধু, ব্যবসায়ী, স্বজনসহ অনেকে এগিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে ৩২ কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, ৪৫০ শতাংশ জায়গার ওপর নির্মিত হচ্ছে মসজিদসহ কমপ্লেক্স। এর মিহরাবের দুই পাশে লাশ রাখার জন্য হিমাগার তৈরি করা হবে। থাকবে পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। মসজিদের ছাদের মাঝখানে থাকবে ৮১ ফুট উচ্চতার একটি বড় গম্বুজ এবং চারদিকে থাকবে ১৭ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ২০০টি গম্বুজ। মূল মসজিদের চার কোনায় ১০১ ফুট উচ্চতার চারটি মিনার থাকবে।

পাশাপাশি ৮১ ফুট উচ্চতার আরো চারটি মিনার থাকবে। ১৪৪ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪৪ ফুট প্রস্থের দ্বিতলবিশিষ্ট মসজিদটিতে একসঙ্গে প্রায় ১৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবে। দেয়ালের টাইলসে অঙ্কিত থাকবে ৩০ পারা পবিত্র কোরআন শরিফ। যে কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে মসজিদের দেয়ালের কোরআন শরিফ পাঠ করতে পারবে। মসজিদের প্রধান দরজা তৈরিতে ব্যবহার করা হবে ২৫ কেজি গোল্ডপ্লেট। আজান প্রচারের জন্য মসজিদের দক্ষিণ পাশে নির্মাণ করা হবে মিনার। এটির উচ্চতা হবে ৪৫১ ফুট, প্রায় ৫৭ তলাবিশিষ্ট ভবনের সমান।

আনুষঙ্গিক পরিকল্পনা সম্পর্কে সমাজসেবী এই উদ্যোক্তা জানান, মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে নির্মাণ করা হচ্ছে পাঁচ তলাবিশিষ্ট পৃথক দুটি ভবন। সেখানে থাকবে দুস্থ নারীদের জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। দেশি-বিদেশি মেহমানদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার জন্য মসজিদের উত্তর-পশ্চিম পাশে ইতিমধ্যে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। পশ্চিমে ঝিনাই নদী থেকে মসজিদ পর্যন্ত সিঁড়ি তৈরি করা হবে। পাশাপাশি নদীর ওপরে একটি সেতু নির্মাণ করা হবে। মসজিদে নামাজ আদায় ও পরিদর্শনে দেশ ও বিদেশের অতিথিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে মসজিদসংলগ্ন হেলিপ্যাডও থাকছে। ধর্মমন্ত্রী আলহাজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান গত ২২ জানুয়ারি এই হেলিপ্যাডের উদ্বোধন করেছেন।

সবশেষে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার জন্ম সাধারণ কৃষকের ঘরে। শৈশবে অর্থাভাবে স্কুলে যেতাম মায়ের সেলাই করে দেওয়া ছেঁড়া লুঙ্গি পরে। শণের ঘরে রাত কেটেছে কাঁচা মেঝেতে শুয়ে। জীবনের শুরুটা এমন অবস্থা থেকেই। ধীরে ধীরে জীবনে প্রতিষ্ঠা এসেছে। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে বঙ্গবন্ধুর ডাকে একাত্তরে হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। স্বাধীনতার বদৌলতে অনেক কিছু পেয়েছি। ভালো চাকরি, ৪৪ বছর ধরে জনতা ব্যাংক লিমিটেডের নির্বাচিত বাংলাদেশ ব্যাংক এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের (সিবিএ) প্রেসিডেন্ট, ২২ বছর ধরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করে আসছি। জীবনে সাফল্য এসেছে। ৬৬ বছর বয়সে এসে নতুন করে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমার সব জায়গা-সম্পত্তি মসজিদের নামে লিখে দিয়েছি। মসজিদের পাশে আমার কবরের জন্য জায়গাও নির্ধারণ করা আছে। এখন একটাই চাওয়া, জীবনের শুরুটা যেভাবে হয়েছে শেষটাও সেভাবেই হোক। তাই তো উপার্জিত সব অর্থ-সম্পদ দিয়ে এমন কিছু করার চেষ্টা করছি যা দেখে মানুষ আমাকে মনে রাখবে। ’

জানা গেছে, বিশ্বের সর্বোচ্চ মিনারটি মরক্কোর কাসাব্লাংকায় দ্বিতীয় হাসান মসজিদে অবস্থিত। সেটির উচ্চতা ২১০ মিটার (৬৮৯ ফুট)। তবে তা ইটের তৈরি নয়। ইটের তৈরি সবচেয়ে উঁচু মিনারটি হলো ভারতের দিল্লির কুতুব মিনার, যার উচ্চতা ৭৩ মিটার বা ২৪০ ফুট এবং এর সিঁড়ি রয়েছে ৩৭৯টি।